এস,আর শরিফুল ইসলাম রতন
লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ-
উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক দর্শনীয় ও সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি তীর্থ স্থান হলো সিন্দুরমতির দিঘী।
ঐতিহাসিকভাবে এ দিঘীটির নাম করণ ও ইতিহাস যেনো রহস্যঘেরা রূপকথার গল্প কেও হার মানিয়ে দেয়। এ দিঘীটি মূলত লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নে সিন্দুরমতিতে অবস্থিত। এ দিঘীর আয়তন ১৬.০৫ একর।
জনশ্রুতি আছে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছর পূর্বে শ্রীলঙ্কা থেকে রাজা নারায়ণ চক্রবর্তী নামে একজন নিঃসন্তান ব্রাহ্মণ সন্তান লাভের আশায় সস্ত্রীক তীর্থ স্থান ভ্রমণে বেড়িয়ে নৌপথে এখানকার দেউল সাগর মন্দিরে এসেছিলেন। সেই সময় দেউল সাগর সনাতন সম্প্রদায়ের একটি প্রসিদ্ধ তীর্থ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল । মন্দিরটির চারিদিক পানি ছিল।
রাজা নারায়ণ চক্রবর্তী এবং তার ধার্মিক স্ত্রী শ্রীমতী মেনেকা দেবী এখানে ত্রিদিবস-রজনী যাপনের পর এখানের মনোরম পরিবেশের আকর্ষণে আর ফিরে যাননি। এখানে তারা নতুন আবাসস্থল গড়ে তোলেন। তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে প্রত্যন্ত এ এলাকা পরিণত হয় ঐশ্বর্যমণ্ডিত এক শান্তির রাজ্যে।
প্রতিষ্ঠিত হয় রাজা নারায়ণ চত্রুবর্তীর জমিদারিত্ব। এদিকে জমিদারের স্ত্রী শ্রীমতী মেনেকা দেবীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয় অপরূপ দুই কন্যা সন্তান। যাদের নাম রাখা হয় সিন্দুর ও মতি। সময়ের পরিবর্তনে দিনে দিনে সিন্দুর ও মতি শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেন।
এমন তো অবস্থায় হঠাৎ করে জমিদারের সুখী সমৃদ্ধ রাজ্যে আকস্মিকভাবে দেখা দেয় তীব্র খরা । এ খরায় খাল-বিল সব শুকিয়ে যায়। পানির জন্য রাজ্যজুড়ে হা-হা-কার পড়ে যায়। জমিদার প্রজাদের পনির কষ্ট নিবারণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশাল দিঘী খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অন্য জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয় কয়েক হাজার শ্রমিক।
তারা দিনের পর দিন গভীর গর্তর দিঘী খনন করতে থাকে। কিন্তু এত গভীর গর্তর দিঘী খননের পরও পানির সন্ধান মিলছে না। এমন অবস্থায় চিন্তিত জমিদার রাতে গঙ্গা দেবীর স্বপ্নাদেশে জানতে পারেন যে, তার দুই কন্যাকে নিয়ে দিঘীর মাঝখানে যথারীতি উপাচারসহ ভগবানের পূজা করলে তবেই পানি উঠবে এ দিঘীতে।
স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী জমিদার রাম-নবমীর তিথির দিনে পূজার আয়োজন করেন। এ খবর শুনে রাজ্যের লোকজন এসে দিঘীর পাড়ে জমায়েত হতে থাকেন।
জমিদার তার আদরের দুই কন্যাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে দিঘীলপাড়ে এসে হাজির হন। দিঘীর মাঝখানে আলপনা এঁকে পূজার নৈবেদ্যসমুহ সুবিন্যাস্তভাবে সাজানো হয়। পাঠা বলি দিয়ে পূজার কার্য শুরু করা হয়। চারিদিকে ঢাক-ঢোল বাজতে থাকে। সবার দৃষ্টি দিঘীল গভীরের মাঝখানে দিকে, কিন্তু সামান্যতমও পানি ও উঠল না এত কিছুর পরেও । হঠাৎ জমিদারের মনে পড়ে যায় তিনি ভুলে তুলসী পাতা পুজোয় নিয়ে আসেনি। আর তুলসী পাতা না আনলে পূজা সম্পন্ন হবে না।
তাই তিনি সিন্দুর ও মতিকে দিঘীর গভীরে রেখে তুলসী পাতা আনতে ছুটে যান পুষ্প কাননে। আর এমন অবস্থায় হঠাৎ করে দিঘীল গভীর স্থান ভেদ করে বিকট শব্দে তীব্র বেগে জলরাশি বের হয়ে নিমিষেই দীঘিটি
পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়।
পড়ে পূজার চালুনি-বাতি ও নৈবেদ্যসহ বলিকৃত পাঠা জলের উপর ভেসে ওঠে। ঢাক- ঢোল বাদকরা কোনো রকমে সাঁতরিয়ে ডাঙ্গায় উঠে আসে, কিন্তু সিন্দুর আর মতি দিঘী থেকে উঠতে না পারায় দিঘীল গভীর স্থানে পানির নিচে থেকে যায়।
ব্রাক্ষ্মণ জমিদার ছুটে এসে দেখেন , জল দিয়ে দিঘী কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে।
কিন্তু তার আদরের কন্যাদ্বয়? তারা আর জীবিত নেই শুনে শোকে মুর্ছিত হয়ে দীঘিরপাড়ে আছড়ে পড়েন তিনি। মেনেকা দেবীও কন্যার শোকে এ দীঘির জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্ম বিসর্জনের জন্য উন্মাদের মতো ছুটে আসেন তাকে রমনীরা ধরে রাখেন।
এমন ঘটনার পড়ে ওই রাজ্যে দিঘীসহ এলাকাটির নাম হয়েছে সিন্দুরমতি।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের রাম-নবমীর তিথিতে সিন্দুরমতির পূজা উপলক্ষে দিঘীরপাড়ে বিরাট মেলা বসে এবং শত শত পাঠা বলি দেয়া হয়। বর্তমানে রাম-নবমীতে দূরদূরান্ত থেকে অগনিত দম্পতি এখানে আসে যুগল স্নানের জন্য। সুখ-শান্তিময় দাম্পত্য জীবন লাভের আশায় তারা প্রাতকালে এ দিঘীল পানিতে ডুব দেয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রথা চলে আসছে।
এখানে প্রতিবছর মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও পাশের দেশ ভারত থেকে হাজার হাজার দম্পতি, পূণ্য লাভের আশায় এ দিঘিতে আসেন।