পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা পৌরসভার পলাশপুর এলাকায় একটি চিহ্ণিত চক্রের বিরুদ্ধে ভূমি জবরদখলের অপচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে । জবরদখল অপচেষ্টার অংশ হিসেবে চক্রটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ভূমির গাছপালা কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন ভূমির মালিক মহসিন শেখ।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মহসিন শেখ কয়েক বছর আগে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে চল্লিশ শতক জায়গা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেনের কাছে বিক্রয় করেন। বছর খানেক আগে হঠাৎ একদিন দেখতে পান, পলাশপুর এলাকার গাছ ব্যবসায়ী ওলি, এন্তাজ, বাবুল ও আবুগং তার মালিকানাধীন জায়গার গাছ কাটতে শুরু করেছে। সে বাধা দিতে গেলে তারা জানায়, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন, বিষ্ণু পদ পালিত, কাজল বৈদ্য ও গুলজার হোসেনের কাছ থেকে তারা এ বাগান কিনে নিয়েছে। গাছ ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় তারা মহসিন শেখের বাধা না শুনে গাছ কাটতে থাকে । শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে তারা জোর করে দ্রুততার সাথে কয়েক হাজার ফুট গাছ কেটে নিয়ে যায়। স্থানীয় গণ্যমান্যদের জানিয়ে কোন সুষ্ঠু সমাধান না পাওয়ায় এক পর্যায়ে মামলা করতে বাধ্য হন।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয় জনসাধারণের সাথে আলাপ করে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে আগত ব্যবসায়ী বিষ্ণু পদ পালিত, কাজল কান্তি বৈদ্য, রেজা মো: গুলজার হোসেন ও সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরীগং একটি সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু চক্র। এ চক্রটি ইতোপূর্বে পলাশপুর এলাকার এক সময়ের প্রয়াত মুরুব্বি ও লিডার হায়দার আলী তালুকদার চেয়ারম্যানের ভূমি জবরদখলের অপচেষ্টা চালায়। নির্ভরযোগ্যসূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক বিরোধের সূত্র ধরে ২০০১ সালের বি এন পি- জামায়াত সরকারের শাসনামলে খোকন শিকদারের নেতৃত্বাধীন এলাকার একটি দুষ্টচক্র হায়দার আলী তালুকদার চেয়ারম্যানকে জোর জবরদস্তি ও রাজনৈতিক নিপীড়নের মুখে পলাশপুর এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। হায়দার আলী তালুকদার এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পলাশপুর এলাকার খোকন শিকদারের নেতৃত্বাধীন দূষ্ট ভূমিখেকো চক্রের যোগসাজশে চট্টগ্রামের একটি ভূমিখেকো চক্র বিষ্ণু পদ পালিত, কাজল কান্তি বৈদ্য, রেজা মো: গুলজার হোসেন ও সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরীগং নানা প্রকার জালজালিয়াতি করে কাগজপত্র তৈরি করে হায়দার চেয়ারম্যানের জায়গাজমি কিনে নিয়েছেন বলে এলাকায় প্রচার করতে থাকেন। চট্টগ্রাম থেকে আগত এ ভূমিখেকো চক্রটি এলাকায় নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল, মসজিদে বিভিন্ন অনুদান দিতে থাকে। এমনকি এলাকার দু-একটি দরিদ্র পরিবারেও দান অনুদান দিতে থাকে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, হায়দার চেয়ারম্যান ২০১৬ সালে মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া জায়গাজমি নিজেদের নামে রেজিষ্ট্রি করে নেয়ার লক্ষে তারা আদর্শগ্রামের শাহজাহানদের রেজিষ্ট্রি করা দেড় একর জায়গার কাগজ স্থানীয় দুষ্ট চক্রের মাধ্যমে কঠিন গোপনীয়তার মাধ্যমে চুরি করে কিনে নিয়ে ওই কাগজ দিয়ে হায়দার চেয়ারম্যানের জায়গা নিজেদের নামে রেজিষ্ট্রি করার অপচেষ্টা চালায় যাকে স্থানীয় ভাষায় ফিটিং রেজিষ্ট্রি বলা হয়। অর্থাৎ একজনের জায়গা জালিয়াতি করে আরেকজন নিজেকে মালিক দাবি করে রেজিষ্ট্রি দেয়ার প্রক্রিয়াকে ফিটিং রেজিষ্ট্রি বলে। শাহজাহানদের ভাইদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়ায় এক পর্যায়ে ফিটিং রেজিষ্ট্রির দুষ্টকর্ম থেমে যায়। তবে চলতে থাকে চাঁদাবাজি, গাছকাটা ও নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা। মিথ্যা মামলা চালাতে গিয়ে এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন।
উল্লেখ্য,পলাশপুর এলাকার এক সময়ের অভিভাবক হায়দার চেয়ারম্যানের জায়গা জমি জবরদখলে নেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত চট্টগ্রাম থেকে আগত ভূমিখেকো চক্রটিই এবার আরেক স্থানীয় বাসিন্দা মহসিন শেখের মালিকানাধীন জায়গাজমি জবরদখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহসিন শেখ জানান, আমরা এখানে ১৯৭৯ সাল থেকে বসবাস করে আসছি। সরকার আমার বাবাকে এখানেই সেটেল্ড করেছে এবং ভূমি বন্দোবস্তি দিয়েছে। আমরা ভাইবোনেরা এখানেই বড় হয়েছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের এখানেই জন্ম হয়েছে। তারা এখানেই বড় হয়েছে এবং নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত আছে। চট্টগ্রামের ভূমিখেকো চক্রের সদস্য সাজ্জাদ হোসেনের তার হীন পরিকল্পনার সুদূরপ্রসারী অংশ হিসেবে আমার কাছ থেকে চল্লিশ শতক জায়গা কিনে নেয়। এখন সে আমার পুরো জায়গা জবরদখলের অপচেষ্টা করছে। আমার কাছ থেকে চল্লিশ শতক জায়গা কেনার সূত্র ধরে তারা এখন আমার জায়গা জবরদখলের চেষ্টা যেভাবে করে যাচ্ছে একইভাবে পাশের হায়দার চেয়ারম্যানের জায়গাও জবর দখলের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। সাজ্জাদ হোসেন আমার কাছ থেকে যে জায়গা কিনেছে সেখান থেকে গাছ না কেটে আমার জায়গার গাছ কেটে নিয়ে গেছে। গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আদালতে মামলা করেছি। আমার জায়গার সুরক্ষার জন্য এ ডি এম কোর্টে মামলা করেছি ।
মহসিন শেখ আরও জানান, চট্টগ্রামের ভূমিখেকো চক্রের প্রধান হোতা খোকন শিকদার। খোকন শিকদার পলাশপুর এলাকার লোকজনের মধ্যে ভূমিবিরোধ লাগিয়ে রেখেছেন তার ব্যবসায়িক স্বার্থে ; এটাই তার পেশা ও নেশা বলে জানান, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রাও।
স্থানীয় দলিল লিখক আলাউদ্দিন সরকার হবি জানান, গত দুই যুগের বেশি সময়কাল ধরে খোকন শিকদারের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি কুচক্রী মহল জায়গাজমির বিরোধ ও মামলা মোকদ্দমা দিয়ে পুরো পলাশপুর এলাকাকে নরকে পরিণত করে রেখেছে। একজনকে দিয়ে আরেকজনের জমি দখল, খুনখারাবি করানো, নারী নির্যাতন, হুমকি ধমকি দেয়া এবং মামলা মোকদ্দমা করে বেড়ানোই তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ; এটাই তার পেশা ও রুটি-রুজির একমাত্র পথ। বিভিন্ন ভূমিদস্যু চক্রকে এলাকায় নিয়ে এসে গ্রামের সাধারণ মানুষদের ফুসলিয়ে একটু আধটু জমি কিনে বাকি জায়গাটুকুন হয়রানি করে চলে-বলে -কৌশলে জবরদখল করাই তার একমাত্র কাজ। তার হীন পরিকল্পনার ও কর্মকাণ্ডের অংশ হচ্ছেন হায়দার চেয়ারম্যান, মহসিন শেখ ও মাজেদা প্রমুখ।
স্থানীয় মুরুব্বি লাল মিয়া জানান, খোকন শিকদারের নোংরা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হায়দার চেয়ারম্যানের জায়গা জবরদখলের চেষ্টা চলমান আছে। এখন আবার মহসিন শেখের জায়গাও জবরদখলের অপচেষ্টা শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে মহসিন শেখের জায়গার গাছ-গাছালি কেটে ফেলেছে।
স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী শাফিউল আলম বলেন, খোকন শিকদার ও তার আত্মীয়স্বজনের নির্যাতনে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। খোকন শিকদারের নেতৃত্বে ভূমি জবরদখল ও মামলা-মোকদ্দমার কারনে মানুষের জীবন প্রচণ্ড দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ শান্তি চায়। এ দুরাবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গে শাফিউল আলম বেশকিছু কাগজ পত্র দেখিয়ে জানান, হায়দার চেয়ারম্যানের সাথে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জায়গাজমি বেচাকেনার ডকুমেন্টস অধিকাংশই অসম্পূর্ণ,অস্বচ্ছ ও সাজানো এবং মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনের। লেনদেনের ডকুমেন্টগুলো সততার সাথে হয়নি এটা সহজেই বুঝা যায়। যাকিছু দেখা যায় সবটাই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী বিষ্ণু পদ পালিতকে মুঠোফোনে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
খোকন শিকদার জানান, আমি জানি হায়দার চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে জায়গা বিক্রি করে গেছেন। ওদের কাছ থেকে বাবুল,এন্তাজ,ওলি এবং আবু বাগান কিনে নিয়েছে। বাগানের ক্রেতা দাবিদার বাবুল জানান, জায়গার মালিকানা আমার বক্তব্য নেই। আমরা বাগান কিনেছি ; গাছ পাইলে আমাদের আর কোন দাবি নেই। বাগানের অপর দুই ক্রেতা আবু ও এন্তাজ বাগান কেনার লিখিত কাগজপত্র আছে জানালেও এবং সেটা দু-এক দিনের মধ্যে দেখাবেন বলে ওয়াদা করেও পরে আর দেখাতে পারেননি। বাগানের ক্রেতা দাবিদার বাবুল, এন্তাজ, ওলি এবং আবুদের ঘনিষ্ঠ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, এরা মূলত বাগান কেনে নাই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এ জায়গাগুলো দখল করে দেয়ার বিনিময়ে বাগানের গাছ কেনার মতো নাটক সাজিয়েছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সাথে এদের কোন বেচা-কেনাই হয়নি। এটা হলো খোকন শিকদারের নেতৃত্বে জায়গা জবরদখলের নাটক। এরা এলাকায় এসব নাটক করে থাকে। কারণ, এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় পলাশপুর এলাকায় মাটিরাঙ্গা-তবলছড়ি -তাইন্দ্যং সড়কের পাশের অধিকাংশ জায়গাজমিই খাসভূমি। ফিটিং রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে অনেকেই খাসভূমি নিজের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছে। খাসভূমি জবরদখলের নোংরা প্রতিযোগিতা থেকেই পলাশপুরের যত্তসব অশান্তি ও মামলা-মোকদ্দমার জঞ্জাল।