ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:
ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর জমিদার বাড়ি মসজিদ। প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশ থেকে দর্শনার্থী আসে মসজিদটি একঝলক দেখতে।
ঠাকুরগাঁও জেলার ৫ টি উপজেলায় ছড়িয়ে থাকা অনেক পুরাকীর্তির মধ্যে ২৪০ বছরেরও অধিক পুরাতন জামালপুর জমিদার বাড়ির এই মসজিদটি ।
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত জামালপুর জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ। এর নির্মাণশৈলী ও অপূর্ব কারুকাজ মুগ্ধ করে মানুষকে। ১৭৮০ শতাব্দীতে মসজিদটির ভিত্তিস্থাপন করেন তৎকালীন জমিদার আব্দুল হালিম চৌধুরী। তৎকালীন জমিদার ও মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস জানতে হলে ১৭৭০ দশকের কথা জানতে হবে। জামালপুর চৌধুরী পরিবার সূত্রে জানা যায়, পশ্চিম বাংলার তৎকালীন উত্তর দিনাজপুরের বালুর ঘাট মহকুমার রায়গঞ্জ থানার বারোর পরগনা তাজপুর গ্রামে পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল হালিম। ১৭৬৫ সালের দিকে আব্দুল হালিম কাপড়ের ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাজপুর থেকে বসন্তনগরে আসে। যার বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে জামালপুর এবং সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন। কাপড়ের ব্যবসা করতে করতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের জমিদার লালা মুক্তি প্রসাদ নন্দের কাছে লাটের পারপূগী মৌজার প্রায় ১ হাজার বিঘা জমি ক্রয়ের মাধ্যমে জমিদারি ক্রয় করেন আব্দুল হালিম চৌধুরী। ১৭৭০ দশকের দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া প্রশাসন তাকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন। জমিদার থাকাকালীন পর্যায়ক্রমে তিনি মোট ২৬ হাজার একর জমি কেনেন। বর্তমানে সেই জমি ৩ জেলার ৮টি থানা /উপজেলায় পড়েছে। সেগুলো হলো- আটোয়ারি, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর, রায়গঞ্জ, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ, বীরগঞ্জ, ও ঠাকুরগাঁও সদর । তখন তিনি ব্রিটিশ চৌধুরী নামে খ্যাত ছিলেন। আব্দুল হালিম চৌধুরী ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তার রাজ প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রাজ প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলাকালীন ১৭৮০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহবাদ থেকে মিস্ত্রী নিয়ে এসে মসজিদের ভিত্তিস্থাপন করেন তিনি। এর কিছু দিন পর আব্দুল হালিম চৌধুরীর মৃত্যু হলে জমিদারিত্ব করেন তার ছেলে রওশন আলী চৌধুরী। এরি মধ্যে রওশন আলী চৌধুরীর মৃত্যু হলে তার ছেলে জামাল উদ্দীন চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব নেন ও মসজিদ নির্মাণ কাজ চলমান রাখেন। জামাল উদ্দীন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে নুনু মোহাম্মদ চৌধুরী ১৮০১ দশকে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। মসজিদটি নির্মাণ করতে চার পুরুষ ও প্রায় ২১ বছর সময় লাগে। মসজিদ নির্মাণের প্রধান দুই মিস্ত্রী হংস রাজ ও রামহিৎ দুই জনে হিন্দু ধর্মের ছিলেন। জমিদার বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার ফলে মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়ির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জ হাট। হাটের পশ্চিমে জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ। মসজিদ অঙ্গণে প্রবেশমুখে বেশ বড় তোরণ রয়েছে। মসজিদটির শিল্পকলা দৃষ্টিনন্দিত, মনোমুগ্ধকর ও প্রশংসাযোগ্য। মসজিদে বড় আকৃতির তিনটি গম্বুজ আছে। গম্বুজের শীর্ষদেশে পাথরের কাজ করা। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিনারগুলো। মসজিদের ছাদে ২৪টি মিনার আছে। একেকটি মিনার ৩৫ ফুট উঁচু এবং প্রতিটিতে নকশা করা রয়েছে। গম্বুজ ও মিনারের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য। এত মিনার সচরাচর মসজিদে দেখা যায় না। মসজিদটির চারটি অংশ হলো মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা, ছাদবিহীন বারান্দা এবং ছাদবিহীন বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের উপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। খোলা বারান্দার প্রাচীরে এবং মূল দরজার ছাদে ছোট ছোট মিনারের অলংকার রয়েছে। মসজিদটির মূল দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ৬ ইঞ্চি। প্রস্থ ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। মসজিটির বারান্দা দুটি। প্রথম বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং দ্বিতীয় বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। মূল কক্ষের কোণগুলো তিন থাম বিশিষ্ট। এর জানালা দুটি, দরজা তিনটি, কুলুঙ্গি দুটি। মসজিদটির ভিতরে দরজায়, বারান্দায় এবং বাইরের দেয়ালে প্রচুর লতাপাতা ও ফুলের সুদৃশ্য নকশা রয়েছে।
১৮৮৫ সালের দিকে ইমদাদুর রহমান চৌধুরী সেই স্থানটির নাম বসন্তনগর পরিবর্তন করে জামাল উদ্দীন চৌধুরীর নামানুসারে জামালপুর করেন। বর্তমানে এটি জামালপুর এস্টেট নামে পরিচিত। আর জামালপুর চৌধুরীর নামানুসারে গঠিত হয় ১০নং– জামালপুর ইউনিয়ন। চৌধুরী পরিবারের ৮ পুরুষের সর্বশেষ জমিদারিত্ব করেন করিম উদ্দীন আহম্মদ চৌধুরী ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। এরপর জমিদারি না থাকলেও মসজিদ দেখাশোনা ও এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ভার বহন করে যাচ্ছে পরিবারের পরবর্তী সময়ের সদস্যরা। তবে এখন মসজিদ উন্নয়ন ও সংস্কারে সরকারি সহযোগিতা চান চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা। জামালপুর জমিদার বাড়ির ৯ম পুরুষের সদস্য আবেদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ১০ থেকে ১৫ বছর আগে মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিলেও এখন পর্যন্ত সংরক্ষণে তারা পদক্ষেপ নেয়নি। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার যদি মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য সুদৃষ্টি দেয় তাহলে এটি দৃষ্টিনন্দিত হয়ে থাকবে বলে জানান তিনি।
১৯৯৫ সাল থেকে মসজিদের ইমামতি করে আসছেন হাফেজ রুহুল আমীন। তিনি বলেন, ‘মসজিদটি দেখতে শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, বিদেশ থেকেও মানুষ আসে। এখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে মসজিদটি দেখতে। এতে আমাদের খুব ভালো লাগে।’
মসজিদটি দেখতে আসা দর্শনার্থী রহমত আলী বলেন, ‘যা আগে কখনও দেখিনি তা এখানে এসে দেখে অভিভূত হলাম। যেহেতু এটি অতি পুরাতন মসজিদ তাই এটিকে সংরক্ষণের জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি। মসজিদটি সংরক্ষণ করা গেলে অদূর ভবিষ্যতের এটি দীর্ঘ দিন স্থায়ী হবে।’